১৯ আগস্ট
![]() |
| ছবিঃ শাহ আরেফিন টিলা |
সিলেটের ঐতিহাসিক শাহ আরেফিন টিলা একসময় ১৩৭ একর জুড়ে সবুজে ঘেরা ছিল। এখন সেটি গর্ত আর ধ্বংসস্তূপে ভরা। আশ্চর্যের বিষয়, ১৯৯৫ সালে আইন করেও সরকার ১৯৯৯ সালে এই টিলাকে ইজারা দেয়। তখন থেকেই শুরু হয় টিলা কেটে পাথর তোলার প্রক্রিয়া। মাঝে আইনি জটিলতায় বন্ধ থাকলেও ২০২৪ সালের ৫ আগস্টের পর আবারও অবারিতভাবে পাথর উত্তোলন শুরু হয়। এক বছরের ব্যবধানে পাহাড় মুছে গিয়ে জায়গাটি আজ প্রায় চেনাই যায় না।
গত বছরের আগস্টেও প্রায় ৫০ ফুট উঁচু টিলায় স্থিরভাবে দাঁড়িয়ে ছিল ৭০০ বছরের পুরনো শাহ আরেফিন টিলা মাজার। মাত্র কয়েক মাসেই সেটি মুছে গেছে মানচিত্র থেকে। শুধু এই স্থান থেকেই শত কোটি টাকার পাথর সরানো হয়েছে বলে জানা গেছে।
নাগরিক ভিউ এর অনুসন্ধানে উঠে আসে—প্রভাবশালী এক সিন্ডিকেটই এই লুটপাটের মূল হোতা। প্রায় ২০ জনের নেতৃত্বে বিএনপি, জামায়াত ও আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতাকর্মীরা এতে জড়িত।
তাদের মধ্যে রয়েছেন যুবদল নেতা বাবুল আহমদ (যিনি চেয়ারম্যান প্রার্থী ছিলেন এবং এলাকায় বাবুল চেয়ারম্যান নামে পরিচিত), বিএনপির সেবুল আহমদ, ইসমাঈল মিয়া, আওয়ামী লীগের হুঁশিয়ার আলী, যুবলীগের ফয়জুর রহমানসহ আরও অনেকে। আবার পাথর পরিবহনে ছিলেন জামায়াতের কর্মী ইয়াকুব আলী, যিনি দাবি করেন—গাড়ি থেকে কিনে মিলে বিক্রি করতেন মাত্র সামান্য লাভে।
কিন্তু আওয়ামী লীগের বেশ কয়েকজন স্থানীয় নেতা, যারা ক্ষমতায় থাকার সময় টিলা কেটে সবচেয়ে বেশি লাভবান হয়েছেন, তারা এখন গা-ঢাকা দিয়েছেন।
প্রশ্ন ওঠে—এত বড় লুটপাট প্রশাসন কি জানত না? বরং পুলিশের বিরুদ্ধেই ওঠে পাথরবাহী ট্রাক থেকে চাঁদাবাজির অভিযোগ। নাগরিক ভিউ এর হাতে আসে এমনকি ভিডিও ফুটেজও।
ধলাই নদীর দুই পাড়ে শত শত জায়গা ভাড়া দেয়া হতো উত্তোলিত পাথর মজুত রাখার জন্য। প্রতিদিন লাখ লাখ টাকা হাতবদল হতো। এক নৌকা পাথরের প্রকৃত দাম প্রায় ৮ হাজার টাকা হলেও শ্রমিকদের কাছ থেকে তা কেনা হতো এক-চতুর্থাংশ দামে। লাভের বড় অংশ যেত সিন্ডিকেটের হাতে।
উপজেলা বিএনপির স্থগিত সভাপতি সাহাব উদ্দিন এ লুটে শীর্ষে ছিলেন বলে অভিযোগ ওঠে। এরপর যুবদল নেতা সাজ্জাদ দুদু, বাহার আহমেদ রুহেলসহ আরও অনেকের নাম উঠে আসে। তবে সাহাব উদ্দিন দাবি করেন—তিনি বরং লুট ঠেকাতে আন্দোলন করেছেন।
পাথর লুটপাটের ঘটনায় সামনে আসে আরও ৯০ জনের নাম। যারা সবাই পাথর উত্তোলনের এ প্রক্রিয়ায় নেতৃত্ব দিয়েছেন। পূর্ব পারের জমির দখলদার ও পাথর ব্যবসায়ী তারা। তালিকায় আছেন- জেলা যুবদল সদস্য মোস্তাকিম আহমেদ ফরহাদ, পূর্ব ইসলামপুর ইউনিয়ন যুবলীগের সভাপতি আলিমুদ্দিন, উপজেলা বিএনপির সদস্য হাজী কামাল, যুবদল কর্মী আজিজুল মাহমুদ, সাবাহ উদ্দিনের ছেলে এজাজ মাহমুদ, ফুপাতো ভাই শৈবাল শাহরিয়ার সাজন, ভাতিজির জামাই সালাউদ্দিন, উপজেলা পরিষদের সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান লাল মিয়া, তার ছেলে রিয়াজ উদ্দিন, জৈন উদ্দিন, উপজেলা যুবদলের আহ্বায়ক সাজ্জাদ হোসেন দুদুর ভাই বোরহান, আজিম, উপজেলা যুবদলের সদস্য মানিক মিয়া, আরমান আহমদ, যুবদল নেতা জাহাঙ্গীর আলম, জাকির, ভোলাগঞ্জ গ্রামের মোজাফর, নুর উদ্দিন, মইন উদ্দিন, সালাউদ্দিন, রাজু মিয়া, রাজু মিয়া, রনি, কালা মিয়া, রোকন মিয়া, লাল মিয়া, আজিজুল, আহাদ মিয়া, বেরাই, দুলাল, তেরা মিয়া, রনি, পাড়ুয়া নোয়াগাঁও গ্রামের সাইফুল, শফিকুল, বাঘারপার গ্রামের আব্দুল মতিন, দক্ষিণ ঢালারপার গ্রামের আব্দুস সালাম, সিদ্দিক মিয়া, মধ্য রাজনগর গ্রামের লায়েক মিয়া, নয়াগাংগেরপার রাজু, আখলু, ইমরান, তৈমুরনগর গ্রামের রাজ্জাক, জব্বার, আহাদ, লায়েক, ঘোড়ামারা এলাকার আশিক।-মোঃ নুর উদ্দিন। পিতার নাম মোঃ জালাল মিয়া গ্রাম- রুস্তুমপুর, শহিদ মির্জা । পিতার নাম মোঃ আতাউর রহমান।গ্রাম ভোলাগন্জ, খুকন আহমেদ। পিতা- মোস্তফা মিয়া গ্রাম- পাড়ুযা নোয়াগাঁও, লালন মিয়া পিতা- মোঃ মানিক মিয়া গ্রাম ভোলাগন্জ, গুচ্ছগ্রাম আবু সাঈদ। বর্তমান ঠিকানা ভোলাগঞ্জ, গুচ্ছগ্রাম, দিলোয়ার মিয়া, পিতা- মঙ্গল মিয়া, মারুফ মিয়া, পিতার নাম মোঃ চান মিয়া গ্রাম ভোলাগন্জ, আফাজ উদ্দিন পিতা- মোঃ মঙ্গল মিয়া, ইয়ামিন আহমেদ পিতা- রজব আলী। গ্রাম ভোলাগন্জ, জাবেদ মিয়া পিতা-মোঃ তৈমুছ আলী, ইসহাক মিয়া পিতা- মোঃ সৈয়দ আলী গ্রাম নোয়াগাঁও, আনিছ আলী। পিতা- মৃত নুরু মিয়া, জুবেল আহমেদ, পিতা- মৃত সৈয়দ আলী, গ্রাম নোয়াগাঁও, ফারুক মিয়া পিতা-মৃত সোনাউল্লাহ, যোবেদ আলী পিতা-মোঃ তরমুজ আলী, নয়ন আহমেদ পিতা মুজিব মিয়া গ্রাম ভোলাগন্জ, গুচ্ছগ্রাম, সোহেল পিতা- মোঃ হযরত আলী, গ্রাম রুস্তমপুর, মিলন পিতা-মোঃ শরীফ উদ্দিন, মিজান আহমেদ, গুচ্ছগ্রাম, শেমল আহমেদ, পিতা- মোঃ সবুজ মিয়া, গ্রাম ভোলাগন্জ, গুচ্ছগ্রাম, রাসেল,পিতা-মখলিছ,কলাবাড়ী, সমর, পিতা- মনাই,গ্রাম কলাবাড়ী, ছামি, পিতা-মোঃ তারা মিয়া গ্রাম :কলাবাড়ী, ফরান, মেগারগাও, সেলিম, পিতা- মোঃ ময়বুর, কলাবাড়ী, হুমায়ুন, পিতা- মোঃ মৃত মনির, গ্রাম কলাবাড়ি, নুরালম, পিতা- মোঃ শফিক, গ্রাম কালাবাড়ি, সুকুর, পিতা-মনাই, গ্রাম: কলাবাড়ী, নুর আলম, পিতা- মোঃ আবদুল মোছাব্বির, দয়ারবাজার, মাসুম পিতা- তাজু মিয়া, গুচ্ছ গ্রাম, ফকরউদ্দিন পিতা- মৃত কামাল মিয়া, ভোলাগন্জ গুচ্ছগ্রাম, আবুল মিয়া, কয়েছ মিয়া পিতা- গুলজার, গ্রাম ভোলাগঞ্জ গুচ্ছ গ্রাম, উজ্জ্বল আহমেদ পিতার নাম মোঃ আইনুল মিয়া গ্রাম ভোলাগঞ্জ গুচ্ছ গ্রাম, ইমরান, পিতা- আলাউদ্দিন, কলাবাড়ি, আতিক, পিতা- মোঃ সৌইবুর, কলাবাড়ী, সুবেল, পিতা- আব্দুল আলী, গ্রাম কলাইরাগ, কনাই মিয়া, আব্দুল গনি, গ্রাম কলাবাড়ি,
এছাড়া ছাত্রদল নেতা হাফিজুর রহমান হাবিব, মোফাজ্জল হোসেন রোমান, জুবায়ের, হারুনুর রশিদ, আমিন রহিম।
আছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক পরিচয়ে হুমায়ুন আহমেদ হুমন আর সাব্বিরের নামও। ভোলাগঞ্জের খেলার মাঠে পাওয়া গেলো হুমনকে। তার দাবি, বৈধভাবে পাথর উত্তোলনের আন্দোলন করছেন তিনি।
অন্যদিকে, পরিবেশবাদী সংগঠনগুলো দীর্ঘদিন প্রতিবাদ করলেও কার্যকর কোনো ব্যবস্থা নিতে পারেনি। বেলা’র বিভাগীয় সমন্বয়ক শাহ সাহেদা আক্তারের ভাষায়—“চেহারা পাল্টালেও অবৈধ কার্যক্রম বন্ধ হয়নি।”
অভিযোগ আরও আছে—পাথর লুট চলাকালীন সময়ে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ঘটনাস্থলেই উপস্থিত থেকেও ব্যবস্থা নেননি। অথচ এখন তাকেই তদন্তের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে।
সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, শুধু গত এক বছরে সাদাপাথর, জাফলং, আরেফিন টিলা ও রাংপানি এলাকা থেকে প্রায় ৩ কোটি ঘনফুট পাথর তোলা হয়েছে। উদ্ধার করা গেছে মাত্র ৫ লাখ ঘনফুট। বাকি অংশ ইতোমধ্যেই বাজারে বিক্রি হয়ে গেছে বা ক্রাশারে গুঁড়িয়ে ফেলা হয়েছে। ফলে প্রকৃত ক্ষতি আর পুষিয়ে নেয়া সম্ভব নয়।

