১০ সেপ্টেম্বর ২০২৫
![]() |
ছবি ঃ লেখকঃ সাইদুল হাসান নাছিম |
লেখকঃ সাইদুল হাসান নাছিমঃ
১৮৫৭ সালের স্বাধীনতা আন্দোলনের অগ্নিশিখার স্ফুলিঙ্গ যাঁদের হাত ধরে প্রজ্বলিত হয়েছিল, তাঁদের মধ্যে মৌলভী আহমাদুল্লাহ অন্যতম। যিনি মৃত্যু অবধি সায়্যিদ আহমদ শহীদ বেরলভী (রহ.) ও ইসমাইল শহীদ (রহ.)-এর জিহাদি আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছেন। ১৮৫৭ সালের স্বাধীনতা আন্দোলনে তিনি অসামান্য অবদান রাখেন।
ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথম দশকে হিন্দুস্থানের পাটনার বিখ্যাত সাদিকপুরে এক সম্ভ্রান্ত ও ধনাঢ্য পরিবারে তাঁর জন্ম হয়। ছোটবেলা থেকেই পড়াশোনায় তিনি প্রখর মেধার অধিকারী ছিলেন। একাধারে আরবি, ফারসি, উর্দু ও ইংরেজি ভাষায় সুপণ্ডিত ছিলেন। কর্মজীবনের প্রারম্ভে সরকারি চাকরিজীবী ছিলেন। সরকারি চাকরিজীবী হওয়ার সুবাদে জিহাদি আন্দোলনে বহুমুখী খেদমত করার সুযোগ তাঁর হয়েছিল। তাঁর কারণেই মুসলমানদের জন্য ব্যাপক মুজাহিদ বাহিনী ও অর্থ সরবরাহ করা সম্ভব হয়েছিল।
তিনি জীর্ণশীর্ণ ও সাদাসিধে জীবন যাপন করতেন। ফলে ইংরেজ গোয়েন্দারা তাঁকে পাকড়াও করতে অপারগ ছিল। তারা এতটুকু জানত যে, একজন দরবেশ প্রতিটি এলাকায় গিয়ে লোকজনকে স্বাধীনতার জন্য প্রস্তুত করছে। কেননা, তিনি যেসব এলাকায় ভ্রমণ করেছিলেন সেসব এলাকাই স্বাধীনতা সংগ্রামের কেন্দ্রে পরিণত হয়েছিল। অনেক ইতিহাসবিদ বলেন, তিনিই ছিলেন স্বাধীনতা সংগ্রামের মূল হোতা। তাঁর মাধ্যমেই সমগ্র ভারতবর্ষে ইংরেজদের বিরুদ্ধে জমে থাকা বারুদ বিস্ফোরিত হয়েছিল।
তৎকালীন লখনৌর তিলসাম পত্রিকা তাঁর নামে সংবাদ প্রচার করে। সেখানে উল্লেখ করা হয়েছিল—
“ইদানীং আহমাদুল্লাহ নামে এক ব্যক্তির তৎপরতা দেখা যাচ্ছে। যেখানে তিনি সফর করেন, সেখানেই তাঁর মজলিসে লোকের সমাগম বেশি হয়। স্থানীয় মানুষদের নিকট তিনি বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছেন।”
অনেকেই মনে করেন স্বাধীনতা আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখা “চাপাতি রুটি” বিলি তাঁর মাধ্যমেই সূচনা হয়েছিল।
শাহ ওয়ালিউল্লাহ (রহ.)-এর চিন্তাধারা নিয়ে স্বাধীনতা সংগ্রামের সর্বাগ্রে অংশগ্রহণ করেছিলেন হাজারো উলামায়ে কেরাম। আর তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন মৌলভী আহমাদুল্লাহ শাহ। স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস থেকে এই মৌলভীদের যদি আমরা পৃথক করে দিই, তাহলে তা আমাদের জন্য হবে আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত। কারণ তাঁদের জীবন পর্যালোচনা করলে দেখা যায়—স্বাধীনতা আন্দোলনে সবচেয়ে বড় ভূমিকা যাঁরা পালন করেছিলেন, উলামায়ে কেরাম তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য।
মৌলভী আহমাদুল্লাহ শাহ সম্পর্কে বিভিন্ন নথিপত্র থেকে জানা যায়, ১৮৪৭ সাল থেকে তিনি স্বাধীনতা সংগ্রামের আহ্বান নিয়ে পুরো ভারতবর্ষের আনাচে-কানাচে ছুটে বেড়িয়েছেন। ১৮৫৫ সালের মধ্যে তিনি তাঁর মূল পরিকল্পনাগুলো গুছিয়ে এনেছিলেন এবং ক্রমান্বয়ে তাঁর জনপ্রিয়তা মুসলমান ছাড়াও হিন্দুদের মাঝেও ছড়িয়ে পড়েছিল।
লখনৌর তিলসাম পত্রিকার সংবাদ প্রচারের পর তাঁর চলাফেরার উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয় এবং বিভিন্ন এলাকায় তাঁকে প্রবেশে বাধা দেওয়া হয়। কিন্তু তিনি দমে না গিয়ে অন্য এলাকায় ছুটে বেড়ান। এভাবে সমগ্র ভারতে স্বাধীনতাকামী মানুষদের নিকট আহমাদুল্লাহ এক প্রিয় ব্যক্তিত্ব হয়ে উঠলেন। অন্যদিকে, ইংরেজদের কাছে তিনি ছিলেন এক আতঙ্কের নাম।
জানা যায়, সে সময় ইশতেহারগুলো গোপনে প্রচার-প্রসার করা হতো। পুরোনো বাড়ির দেয়ালে, জামে মসজিদের ফটকে, সরু গলিতে, বাজারের দোকানগুলোর সামনে রাতের আঁধারে ইংরেজবিরোধী ইশতেহার কে যেন লাগিয়ে যেত। ইতিহাসবিদদের অনেকের ধারণা, এসবের মূল হোতাই ছিলেন আহমাদুল্লাহ শাহ।
একবার তিনি ফৈজাবাদে অবস্থান করছিলেন। এমন সময় সে এলাকায় অবস্থানরত লেফটেন্যান্ট টমাস বুরনকে ইংরেজরা জানায়—“এ এলাকায় এক দরবেশ আগমন করেছে এবং সে লোকজনকে ইংরেজদের বিরুদ্ধে উসকাচ্ছে। তাকে এখনই বন্দি করো।” টমাস বুরন সেনাবাহিনী নিয়ে তাঁকে গ্রেফতার করতে যায়। সে মাওলানাকে আত্মসমর্পণ করতে বলে। কিন্তু মাওলানা তাতে অস্বীকার করে বুরনের উপর আক্রমণ করেন।
এরপর মাওলানা এবং তাঁর অনুসারীদের সাথে ইংরেজ সেনাদের লড়াই শুরু হয়। মাওলানার তিনজন অনুসারী ইংরেজদের গুলিতে নিহত হন। তিলসাম পত্রিকার রিপোর্ট অনুযায়ী—
“মাওলানার অনুসারীদের সাথে সেনাদের যুদ্ধ হয়েছে। এ ছিল তরবারি ও গুলির বিস্ময়কর লড়াই। অন্তত পাঁচজন নিহত হয়েছেন, আহত হয়েছেন অনেক। আহমাদুল্লাহ শাহ আহত অবস্থায় গ্রেফতার হন।”
পরে মাওলানাকে জনগণ কারাগার ভেঙে উদ্ধার করে। উল্লেখযোগ্য রিপোর্ট অনুযায়ী, ১৮৬৫ সালের মে মাসে ইংরেজরা তাঁকে গ্রেফতার করে এবং তাঁর সমুদয় সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করে তাঁকে কালাপানির দ্বীপে নির্বাসিত করে।
২১ নভেম্বর ১৮৮১ খ্রিস্টাব্দ, মোতাবেক ২৮শে মুহাররম ১২৯৮ হিজরি, সোমবার রাত একটায় তিনি ইহকাল ছেড়ে পরলোক গমন করেন। ইন্তেকালের সময় আবদুল ওয়াহেদ নামে এক ব্যক্তি তাঁর পাশে ছিলেন। তাঁর লাশ আন্দামানের ভাইপার দ্বীপের “ডানডাস পানিট”-এর সাধারণ গোরস্থানে দাফন করা হয়।
সূত্রঃ ১৮৫৭ স্বাধীনতা যুদ্ধের উপাখ্যান – ইমরান রাইহান,
কালাপানি নির্বাসিতের আত্মকাহিনি – নূরুল হাসান ইবনে মুখতার